বায়োলজির অঘটনঘটনপটিয়সী: তেলেসমাতি এনজাইম - পর্ব ১

10/05/2025

Written by: Dr. Susmit Islam

246 views
বায়োলজির অঘটনঘটনপটিয়সী: তেলেসমাতি এনজাইম - পর্ব ১

কিছুদিন আগে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, সেটায় মূল প্রশ্ন ছিল type 1 respiratory failure আর type 2 respiratory failure এর মধ্যে মূলত কোন পার্থক্যের জন্য একটায় CO2 retention হয়, কিন্তু আরেকটায় হয়না। আমরা দেখেছিলাম এখানে মূল ফিজিওলজিক্যাল প্রিন্সিপল যেটার কারণে এই এফেক্ট arise করছিল, সেটা হল O2 পানির সাথে রিয়েকশন করেনা, কিন্তু CO2 করে; তাই O2 এর carrier protein লাগে (Haemoglobin), CO2 এর লাগেনা। Carrier protein সংখ্যায় limited হওয়ায় সেটা saturate হওয়া সোজা, কিন্তু রক্তের plasmaতে H2O এর অভাব নাই, তাই CO2 মোটামুটি আরামসে পানির সাথে বিক্রিয়া করে দ্রবীভূত হতে পারে। তাই CO2 transport সাধারণত saturated হয়না।

তো সেখানে আমার প্রশ্ন ছিল, O2 আর CO2 এর মধ্যে কী এমন পার্থক্য আছে যার দরুণ একজন পানির সাথে বিক্রিয়া করে কিন্তু আরেকজন করেনা? আর সেটার উত্তর ছিল, CO2 অণুতে oxygen আর carbon atom এর মধ্যে তড়িৎ-ঋণাত্মকতা (electronegativity) এর পার্থক্যের কারণে পার্শিয়াল চার্জ তৈরী হয়। আর সেটার কারণে পানি, যেটা একটা পোলার মলিকিউল, সেটার ওপর CO2 গিয়ে এটাক করলে আটকে যাবার একটা চান্স থাকে। যেটা O2 অণুর ক্ষেত্রে থাকেনা, কারণ এখানে দুইটা O atom-ই সমান electronegative.  এটা CO2 + H2O = H2CO3 রিয়েকশনটা হওয়ার মূল কারণ।

তবু কিছু কথা থেকে যায়, যেটা আমার অরিজিনাল পোস্টে সংক্ষিপ্ত পরিসরের কারণে আর পোস্টের থিমের সাথে অ্যালাইন্ড না হওয়ায় পরবর্তী (এই) আর্টিকেলের জন্য জমা রেখেছিলাম, যে ব্যাপারটা কমেন্টবক্সে একজন ভাই চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছিলেন। সেটা হল, রিয়েকশনটা বায়োলজিকাল সিস্টেমে যতটা দরকার তত হারে ঘটানো সম্ভব হতনা আরেকটা জিনিস না থাকলে। সেটা হল Carbonic anhydrase enzyme.

এনজাইম জিনিসটাকে বইয়ের কাঠখোট্টা ভাষায় বাংলা করা হয়েছে অনুঘটক। আভিধানিকভাবে শব্দটার অনু- প্রিফিক্স কী মিন করছে জানিনা, তবে মোটামুটি ধরে নেয়া যায় এটা বোঝায় "বিক্রিয়া *ঘটানোতে* *সাহায্য* করে যে জিনিস"। আক্ষরিক অর্থে ঠিক আছে, তবে শব্দটা ঠিক এনজাইমের পাওয়ারকে ক্যাপচার করেনা। যেমন ধরেন, carbonic anhydrase (CA) না থাকলে গড়ে প্রায় প্রতি ১০ সেকেন্ডে পানির সাথে বিক্রিয়া করে মোটে একটা CO2 অণু। আর একট অণু CA এখানে ঢুকায় দিলে কী হয় শুনবেন? প্রতি ১০ সেকেন্ডে *১ কোটি* CO2 অণু পানির সাথে বিক্রিয়া করে। মানে ১০০ কোটি পার্সেন্ট ইম্প্রুভমেন্ট!!! কত বড় তেলেসমাতি কারবার চিন্তা করে দেখেন! তাই আমি এনজাইমকে আদর করে ডাকি "বায়োলজির অঘটনঘটনপটিয়সী"। ঘটার মত ঘটনা না, এমন ঘটনা ঘটানোটাই তার নিত্যদিনের খেলা। প্রশ্ন হল, এনজাইমরা কীভাবে বায়োকেমিক্যাল অঘটন ঘটায়? 

রসায়নের মূল কাজ বিভিন্ন পদার্থ একসাথে করা হলে তাদের মধ্যে কী পরিবর্তন আসে সেটার পড়াশোনা। আর সেটা করতে গেলে আমাদের শুরু করতে হবে একেবারে গোড়ায়। রসায়নের (বা প্রাণরসায়নের) যেকোন বিক্রিয়া বা প্রক্রিয়া একেবারে গভীর থেকে বুঝতে গেলে আমাদের সর্বোচ্চ গভীরতার পর্যায় হবে অণু। একজন মানুষের মতিগতি বোঝা হল psychology বা মনোবিজ্ঞান, কিন্তু ১০০ মানুষ একত্র হলে সেই দলের মতিগতি বোঝাকে বলে sociology. তেমনি, একটা অণুর মতিগতি বোঝার বিদ্যার নাম পদার্থবিদ্যা হলেও, অনেকগুলো অণু একসাথে হলে তাদের মতিগতি বোঝার বিদ্যাকে বলে রসায়ন। মানে রসায়নকে যদি গভীরভাবে বুঝতে চাই, আমাদের এক চিমটি ফিজিক্সের দরকার। রসায়নবিদেরা রসায়নের এই বিভাগের নাম দিয়েছেন physical chemistry. রসায়নের এই বিভাগে quantum mechanics, statistical mechanics, thermodynamics - পদার্থবিদ্যার মূলত এই শাখাগুলো ব্যবহার করে রাসায়নিক বিক্রিয়া কখন হয়, কেন হয়, কী গতিতে হয় ইত্যাদি ব্যাখ্যা দেয়।

তো এই ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রির একেবারে গোড়ার একটা কনসেপ্ট হল আণবিক গতিতত্ত্বের কলিশন মডেল বা ধাক্কাধাক্কি মডেল। ইংরেজিতে বলে collision model of kinetic molecular theory. এটা কী বলে? 

১. প্রতিটা অণুই গতিশীল।
২. দুইটা অণুর মাঝে বিক্রিয়া হতে হলে তাদের মধ্যে "সঠিক উপায়ে" সংঘর্ষ বা কলিশন হতে হবে।
৩. "সঠিক উপায়ে" কলিশন কী? যেসব কলিশন পর্যাপ্ত শক্তি নিয়ে আর সঠিক দিক থেকে (adequate energy and appropriate orientation) সংঘটিত হবে, সেগুলোর ক্ষেত্রে বিক্রিয়া হবে। অন্যথায় কলিশনে শুধু অণুগুলো একটা অন্যটার গায়ে ধাক্কা খেয়ে রিফ্লেক্ট হয়ে অন্যদিকে চলা শুরু করবে, কোনোরকম রাসায়নিক পরিবর্তন ছাড়া। যেমন নিচের ছবিটা দেখেন।

CO plus O2 reaction

দুইটা রাসায়নিক পদার্থ একসাথে রেখে দিলে দুইটার গতিশীল অণুগুলো ধীরে ধীরে নিজেদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি শুরু করে। সেই ধাক্কাধাক্কির কিছু হয় "সঠিক", কিছু হয় "বেঠিক"। সেকেন্ডে কতগুলো "সঠিক" ধাক্কাধাক্কি হইল, সেটাই নির্ধারণ করে রিয়েকশনের রেট বা বিক্রিয়ার গতি বা বিক্রিয়ার হার। কীভাবে?  ওয়েল, বিক্রিয়া হওয়া মানে মূলত বিক্রিয়কগুলোর অণুগুলোর মধ্যে নতুন কেমিক্যাল বন্ডিং তৈরী হওয়া। সেই প্রক্রিয়ায় আগের বন্ড ভাঙতে পারে, ঢেলে সাজাতে হতে পারে। আর বন্ড ভাঙতে (সাধারণত) শক্তির প্রয়োজন হয়। সেই শক্তি কোথা থেকে আসবে?

অণুগুলোর গতিশক্তি থেকে। আবার একটা অণুর যেকোন জায়গায় গিয়ে আঘাত করলেই যে একটা বন্ড ভেঙে যাবে তা কিন্তু না। সেই বন্ডটা যেই orientationএ আছে, একেবারে সেই বরাবর ক্লিন শট নিলেই কেবল বন্ডটা ভাঙবে। এজন্যই অণুর ধাক্কাধাক্কি মারামারিতে হয় বিক্রিয়া, আর সেই ধাক্কাধাক্কি উপযুক্ত তরিকায় হইলো কিনা, পর্যাপ্ত শক্তি নিয়ে হইল কিনা, তার ওপর নির্ভর করে বিক্রিয়ার গতি। 

দেখেন, বহুদেশ হতে বহুক্রোশ ঘুরে কিন্তু আমরা বিক্রিয়ার হারের প্রশ্নে ফিরে আসলাম। আর এনজাইমের কাজ যেহেতু বিক্রিয়ার হার মডিফাই করা, তাহলে এনজাইমের কলকব্জা বুঝতে বিক্রিয়ার হার নিয়ে দু' কথা সারতে হবে। তাহলে পরের পর্বে ইনশাআল্লাহ আমরা কাইনেটিক থিওরির এই কলিশন মডেল ব্যবহার করে বায়োকেমিক্যাল বিক্রিয়ার হার বুঝব, আর সেই হার কী কী ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভর করে সেটা খানিকটা বুঝব। আমাদের মূল লক্ষ হল, এনজাইম ঠিক কোন লুপহোল দিয়ে বিক্রিয়ার হার বাড়ায় সেটা বোঝা। সেটা বুঝতে গিয়ে বিক্রিয়ার নাটবল্টু, যেমন activation energy, activated complex ইত্যাদি জিনিস নিয়ে নাড়াচাড়া করব আমরা।

তো আজকের মত এইটুকুই। ধৈর্য ধরে পড়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ, আর পরের পর্ব পড়ার জন্যও অগ্রিম আমন্ত্রণ রইল। কোনো মন্তব্য বা পরামর্শ থাকলে অবশ্যই জানাবেন। আসসালামু আলাইকুম